সাদা পৃষ্ঠায় লেখক ভরিয়ে তুলে চারপাশ, সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা অথবা নিজেকে মাতিয়ে রাখে, তাতাঁতে থাকে, শাণ দিতে থাকে তার মন-মগজের যৌথ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। লেখক যখন নিজের দর্শন-ভাবনাগত গুহায় থেকে ধীরে ধীরে ভাবনার পাখিগুলোকে ডানা লাগিয়ে ওড়াতে দিয়েই নিজে ভাবনার গুহায় পড়ে থাকেন আর যখন সাদা পৃষ্ঠাজুড়ে ওড়তে থাকা ভাবনাপাখিগুলো তখন ধরতে গিয়ে পাঠক ছুটে ভাবনাপাখির পিছু পিছু। সে এক অবর্ণনীয় সোন্দর্য্য। পাঠকের চোখজুড়ে, মুখে ওপর বিভিন্ন খেলার উৎস, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, কান্না, হাসি, আফসোস, তীব্র চিৎকার, গালি, বিদ্রোহে ফেটে পড়তে চায়, মুখ-বুক-মন ভরে অনর্গল অফুরন্ত ফুরফুরে বাতাস নিতে থাকে। কিংবা নতুন কোন জগতের ভিতরে ঢুকে গিয়ে অন্যকোন জগতের খোঁজ পেয়ে যায়, সেখানে পাঠক দেখেন সমগ্র বিশ্বকে, বিশ্বের ভিতরে মানুষাবর্তনকে, নিজের ভিতরে খোঁজে পায় সে লেখককে, লেখককে কি ! নাকি পাঠকই খুঁজে পায় নিজেকে ! নিশ্চয় তখন লেখক পাঠকের ভিতরে রুপান্তরিত হয়ে যায়, তখন লেখক-পাঠকের পার্থক্য গুছে যায়। লেখকই হয়ে ওঠেন পাঠক, পাঠকই হয়ে ওঠেন লেখক আর তাদের ভিতরে জন্ম নেয় নতুন কোন কিছু সেটা হতে পারে বিশ্বের বিপরীতে অথবা বিশ্বের ভিতরের সমস্ত বস্তু-অবস্তু। এই ঘোরের ভিতরে পাঠক নির্মাণ করতে থাকে নিজেকে, ভাঙতে থাকে তার চারপাশ, বদলে যেতে থাকে তাকে ঘিরে আবর্তিত দুনিয়া। পাঠককে ঘিরে থাকা মানুষদেরও পাঠক চিনতে থাকে ছট জলদি এবং ক্রমান্বয়ে সেই সব মানুষও বদলাতে থাকে ধীরে ধীরে।
পাঠক-লেখকের মধ্যে যখন পারস্পরিক মেলামেশা হয়ে যায়। তখন পাঠক তাঁর প্রিয়ো লেখককে খুঁজতে থাকে, দেখার করার জন্য মন ছুটতে থাকে উসাইন বল্টের গতিতে। তা স্বাভাবিক। যখন পাঠক তাঁর প্রিয়ো লেখকের দেখা পেয়ে যায় ,তখন পাঠক কি ভাবে ! অথবা পাঠকের তৎক্ষণাৎ কি চিন্তার উদয় হয় তার মন-মগজে! সে কি আনন্দে মাতোয়ারা ! সে কি মর্মান্তিকভাবে হতাশ !
একজন পাঠক যখন তাঁর প্রিয়ো লেখকের সাথে মিশে, কথা বলে তখন সে হতাশও হতে পারে। তার প্রধানতম কারণ হতে পারে, যে প্রিয়ো লেখকের বই তার চিত্তে দাগ কাটে, সমস্ত দিন-রাত তোলপাড় করে, চোখের নিদ্রা ওড়িয়ে দেয়, সে লেখক বাস্তবে হিতে বিপরীত, তার লেখার সাথে ব্যক্তি লেখকের কোন মিল নেই। অভ্যাসগত, আচারণগত, কথা বলার গতানুগতিক রুপ পাঠককে হতাশ করে। সে ভাবতে পারে এই ব্যক্তিই কিভাবে এ রকম ঋদ্ধ লেখা লিখেছে ! কিভাবে তা সম্ভব ! দেখে তো তা মনেহয় না ! হয়তো ভেবেই ফেলে, দেখতে তো দেখি বোকাসোকা অথবা ভাবতে পারে ধান্দাবাজ, ঠকবাজ, প্রতারক, অনর্গল মিথ্যা বলে, মুখোশ পরে থাকে, রগচটা, একরোখা, মারাত্মক অহমিকার মিনার চূড়ায় বসে থাকে, খ্যাতির লোভে মরিয়া, অমিশুক, হিংসুটে, অন্তমুর্খী ইত্যাদি ইত্যাদি হয়তো পাঠক কথা বলতে বলতে ভেবেই নিতে পারে যে, এই ব্যক্তির (লেখক) তো আমার (পাঠক) চেয়ে জানাশোনা কম ! তার কারণ হতে পারে, পাঠক তখন তাঁর প্রিয়ো লেখকের লেখার সাথে দেখা হওয়া লেখকের সামঞ্জস্য করতে থাকে যখন দেখে পাঠক তার প্রিয়ো লেখকের সাথে তার চোখে দেখা, কথা বলা প্রিয়ো লেখককে এক করতে পারেন না তখনই হতাশার উদ্ভব ঘটে।
সব পাঠক কিংবা সব লেখকের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত ভাবনা যেমন সত্যি নয় ঠিক তেমনি পাঠক-লেখকের ভালোবাসা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, প্রগাঢ় সম্পর্কও ঘটে। লেখকরা তো আর মানুষের উর্ধ্বে নন লেখকদের রাগ আছে, আছে ক্ষোভ, হতাশা, ভালোবাসা সব মিলিয়ে রক্ত মাংসের মানুষ কিন্তু পাঠক যখন ভেবে নেয় লেখকরা উদার, অহিংসা, মানবতাবাদী, সত্যবাদী এই ভাবনার ভিতর থেকে যখন প্রিয়ো লেখকে মূল্যায়ন করতে যায় ঠিক তখনই বিপত্তিটা বাধে। প্রতিটি লেখককে ব্যক্তি জীবনে তার সময়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়, লড়াই করতে হয় তলাবিহীন সমাজের সাথে, পৃথিবীর ভিতরে অমানুষদের গড়া বিভিন্ন ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়, সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন শ্রেণি মত-পথের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, লেখককে বাঁচতে হয় পৃথিবীতে থেকে ফলে, লেখককে বিভিন্ন পন্থার অবলম্বন করে টিকে থাকতে হয় যা নিশ্চয় লেখক তাঁর ক্ষুরধারা লেখনীর ভিতরে ফুটিয়ে তুলেন অবচেতনে, উহ্যরুপে কিংবা স্পষ্টরুপে যা পাঠককে খোঁজে নিতে হয়।
পাঠক হিসেবে আমি এই দ্বন্দ্বগত অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে। আমার কাছে মনেহয়, একজন পাঠক তার প্রিয়ো লেখকের সাথে দেখা না করাই শ্রেয় ! তাতে করে পাঠক তার প্রিয়ো লেখককে লেখকের লেখার মধ্য দিয়ে যেভাবে খোঁজে পায় সেভাবেই অটুট থাকুক। যেভাবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দিয়ে কল্পনার রাজ্যে দাঁড় করান সেভাবেই তাঁর প্রিয়ো লেখক অটুট থাকুক।
প্রকাশকাল: ২৪.০২.২০১৭, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন