Ads

সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

‘উমা’র ঝলকানি ও চলচ্চিত্রে বাঁকবদলের পথ


‘উমা’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

মনে আছে ! সেই ‘ছুটির ঘন্টা’ সিনেমাটির কথা ! মনেপড়ে! মনেহয় না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে যে চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমানের রচনা ও পরিচালনায় কালজয়ী এ সিনেমা দেখে নি। স্কুল ছুটির পর আটকা পড়া এক বালকের তীব্র হৃদয়পোড়া গল্পে মোড়া সেই সিনেমা, বুকের ভিতরে এখনো তো ‘ছুটির ঘন্টা’ বাজে। যে কোন পাষাণ হৃদয়ও অনর্গল হাউমাউ করে কেঁদে ওঠবে ছুটির ঘন্টা বালকের কথা মনে করে। এরপরেও হয়তো বহু সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলেছি, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি কিন্তু ভুলে গিয়েছি অথচ এখনও কেন ছুটির ঘন্টার কথা মনে পড়ে! কারণ তো একটাই, যে সিনেমা বুকের ভিতর আছড় কাটে না, সে সিনেমা মনের ভিতর তার নিজস্ব জায়গা তৈরি করবে কি করে! সিনেমার ভূমি তো মন, মনের ভিতরই তার জায়গা আর সেখানে সিনেমাকেই তার নিজস্ব স্টাইলে জায়গা করে নিতে হয়। এখন আর ছাত্রজীবন নেই তবুও ছোট্টবেলায় দেখা ‘ছুটির ঘন্টা’ সিনেমার কথা মনেপড়ে। এবং এ সিনেমা আর দেখিনি ভয়ে, তীব্র কষ্টে চোখের দু’পাতা ভিজবে বলে। বহুবছর পর গত ৩১ আগস্ট রাতে সৃজিত মুখার্জী আবারও দুচোখের পাতা ভিজিয়ে দিল, শত চেষ্টা করেও চোখের পাতা দুটিকে সামলে নিতে পারি নি।

‘ছুটির ঘন্টা’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

সৃজিত মুখার্জীর ‘বাইশে শ্রাবণ’ সিনেমাটি দেখার পর থেকে বুঝে গেছিলাম, বাংলা চলচ্চিত্রের এক সৃষ্টিশীল মহাবাজিকরের আবির্ভাব ঘটেছে, গৎবাধা গল্পের জুড়িকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন রুপের কাঠামো তৈরি করে চলেছে এ চলচ্চিত্রের মহাবাজিকর। সৃজিতের নতুন আরেকটি সিনেমা ‘এক যে ছিল রাজা’ এবারের দুর্গাপূজা উপলক্ষে মুক্তি পাবে ওপার বাংলায়( কলকাতা)। ‘এক যে ছিল রাজা’ দেখার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছি তার নির্বাক, বাইশে শ্রাবণ, অটোগ্রাফ, হেমলক সোসাইটি, জাতিস্মর, চতুষ্কোণ সিনেমাগুলো দেখার নেশার মত। যাইহোক, সৃজিত যেভাবে আমার চোখের দুটি পাতা ভিজিয়ে দিল তার মাধ্যম হলো ‘উমা’। ‘উমা’ সৃজিতের অন্যতম আরেকটি আলোচিত এবং দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র। চলতি বছরের পয়লা জুনে সিনেমাটি মুক্তি পায় তারপর থেকে সাফল্যের সিড়িগুলো একের পর এক অতিক্রম করে চলেছে ‘উমা’। সিনেমাটি সত্যিকার কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। কানাডার অন্টারিও’র জর্জ শহরে বাস করতো ছোট্ট শিশু ইভান লিভারসেজ।ইভান টার্মিনাল রোগে আক্রান্ত, বেশিদিন আর বাঁচবে না, তার ইচ্ছা সে অক্টোবরে ক্রিসমাস (বড়দিন) উৎসব দেখবে । সাত বছর বয়সী ইভান লিভারসেজের স্বপ্ন পূরণের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘উমা’ চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছে সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা সৃজিত মুখার্জী। অসাধারণ গল্পের বুনট, চিত্রগ্রহণ, কালার, লোকেশন, অভিনয় শিল্পীদের অভিনয়, বিশেষ করে অঞ্জন দত্ত, যীশু, শ্রাবন্তী, রুদ্রনীল, অনির্বাণ আর সারার (উমা) অভিনয় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । সিনেমাটির প্রতিটি সংলাপ মনোমুগদ্ধকর। যে পাড়ায় কৃত্রিম দুর্গাপূজা আয়োজন করা হয় সেই পাড়ার মহিতোষ সুর (অনির্বাণ) ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে যখন এ উৎসব বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেই মহিতোষই এক সময় কান্না ধুমড়ে মুচড়ে যান। সাজানো দুর্গা পূজার উৎসবের নবমীতে মহিতোষ সুর যখন বাজার করে হেঁটে বাসায় ফিরছে, তখন উৎসবে অংশগ্রহণকারী দুয়েকজনের কথপোকথনে সে শুনতে পায় যে উমা আর বেশিদিন বাঁচবে না। মহিতোষের অনুশোচনায় ভোগা মুখ এবং পরবর্তীতে সারা যখন প্রসাদ নিয়ে মহিতোষের কাছে এসে ‘আংকেল শুভ মহা নবমী’ বলে সম্ববোধন করে ঠিক এ দৃশ্য বোধহয় কারও সহ্য করার মত নয়। আমার চোখের পাতা মেলে ধরলেও জলপড়ে আবার চোখ বুজলেও চোখের পাতা ভিজে  গেছিল। শুধু সিনেমা কেন আমার কাছে মনেহয় যে কোন শিল্পমাধ্যমে অতিরিক্ত আবেগ শিল্পের ক্ষতি করে, মেদযুক্ত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ‘উমা’ চলচ্চিত্রটি সঠিক আবেগের অনুভূতি লক্ষ্যনীয়, ঝর্ঝরে মেদহীন। ‘উমা’ বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন সুবাতাসের পূর্বাভাস। যেখানে তামিল, দক্ষিণী সিনেমা নকল করে কোনমতে রোগে শোকে বেঁচে থাকা বলিউড, ডালিউড, টালিউড, গল্প না বলার ধুকধুকানিতে ভোগছে ঠিক সে সময় ‘উমা’ নিশ্চয় বাংলা সিনেমার অসামান্য সংযোজন।
মুক্তির অপেক্ষায় ‘এক যে ছিল রাজা’ ছবির পোস্টার

চলচ্চিত্রের বাঁকবদল এখন সময়ের দাবি :
দুই বাংলার চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেশকয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়ে আসছিল। একসময় দেখতে পাই, যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে আমাদের দেশের শিল্পী-কলাকুশলীসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ব্যাপক অসন্তোষ। তা সত্যিই বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত। যৌথ প্রযোজনাতে ব্যাপক অনিয়ম, যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা লঙ্গনসহ নানা বিবিধ কারণে দুই বাংলার চলচ্চিত্রের যে ব্যাপক আকারের সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল তা মাঝপথে এসে খেই হারিয়েছে। বর্তমানে যে সব সিনেমা আদান প্রদান করা হয় তা বোধহয় আমিদানির মধ্য দিয়ে হয়। এটা তো এভাবে চলতে পারে না। এভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের সুদূরপ্রসারী উন্নতির পথ বাধাগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলা চলচ্চিত্র। উভয় বাংলার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের উচিত সঠিক ও বৈধ পন্থার মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলা চলচ্চিত্রকে তুলে ধরা। যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা। বর্তমান সময়ে একঝাঁক মেধাবী, সৃজনশীল নির্মাতাদের দেখতে পাই, তারা বুকের ভিতর সিনেমা নির্মাণের আগুন পোষে রেখেছে, নতুন গল্প, নতুন ভাবনা-দর্শন ছড়াতে মুখিয়ে আছে । প্রতিশ্রুতিশীল এসব মেধাবী, রুচিশীল, ভিন্ন গল্প বলার কারিগরদের ব্যাপক পঠন-পাঠন ও কাজের মধ্যদিয়ে তৈরি করতে উপযুক্ত পৃষ্টপোষকতা বাঞ্ছনীয় । বাংলা চলচ্চিত্রের নবদ্বার উন্মোচন করতে চলচ্চিত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এমন রুচিশীল প্রযোজকদের অংশগ্রহণও জরুরি বলে মনেকরি। নবীন আগ্রহী অভিনয় শিল্পী, কলাকুশলীদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে পাঠদান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করাও চলচ্চিত্র মহলের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। পুরাতন ধ্যান ধারণা, কপি পেস্ট মানসিকতা থেকে আমাদের নির্মাতা, দর্শক ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সকলকে বেরিয়ে আসতে হবে যা এখন সময়ের দাবি। বতর্মান চলচ্চিত্রের দুর্দিন রোধ করতে দর্শকদের হলমুখী করতে দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা এবং থানা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিজিটাল দৃষ্টিনন্দন সিনেমা হল নির্মাণ করা। কিংবা যুগের সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন প্রযুক্তির দিকে সিনেমা মুক্তি ও প্রদর্শনের কথাও ভাবা উচিত। দর্শকদের উচিত পাইরেসি করা সিনেমা দেখব না এমন মানসিকতা মনের ভিতর তৈরি করা কারণ এ মানসিকতাই পারে চলচ্চিত্রের দুর্দিন ঠেকাতে, বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব সিনেমার মঞ্চে দাঁড় করাতে। জয় হোক বাংলা সিনেমার, জয় হোক বিশ্ব সিনেমার।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন