Ads

বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

বাংলা একাডেমির সাথে নিষিদ্ধ শব্দটি বেমানান

যখন শ্রাবণ প্রকাশনীর নিষিদ্ধের খবর শুনেছিলাম তখন খুবই অবাক হয়েছি। সেই সঙ্গে স্নায়ুচাপও হু হু করে বেড়ে গিয়েছিলো। কারণ, যখন মাথা রাগে ক্ষোভে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন তাৎক্ষণিক ক্ষেত্রে কিছু বলতে গেলে ভুল-বাল অনেক কিছু বের হয়ে আসতে পারে। যেমনটা অনেকের ক্ষেত্রে দেখেছি। তাই নিজেকে সংযত রেখে ফেসবুকে বন্ধুদের ক্ষোভ রাগ প্রতিবাদ সংবলিত কথাগুলো পড়ছিলাম। ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধ চারটি রুপেই আমার কাছে সবসময় আবির্ভূত হয়ে এসেছে বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির এহেন বাহ্যিক কর্মকান্ডে লেখক-প্রকাশকদের মনে যে ভীষণ আঘাত দিচ্ছে যা আসলে মুক্তপথের, মুক্তমতের ও বাংলা একাডেমির চরিত্রের পরিপন্থী। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুর দিক থেকে বাংলা একাডেমিতে আমার সচল আসা যাওয়া তা অবশ্য বইমেলা কেন্দ্রিক এবং এক ধরনের আত্মার টানও অনুভব হয়। যখন রাজপথ থেকে বাংলা একাডেমি সংবলিত লগোটা দেখতে পাই তখন মনের ভিতরে আনন্দের এক বুলবুলি নেচে ওঠে। এই যে বাংলা একাডেমির প্রতি একটা অদৃশ্য স্নেহের টান অনুভব হয় (হয়তো আমার মতো অনেকেরই হয়) তার প্রধানতম কারণ মুক্তপথ-মুক্তমতে মুক্তমনা মানুষের পদচারণার কারণে। যেখানে নব সৃজনময় পৃথিবীর মানুষের আনাগোনা। অথচ সাম্প্রতিক কালে আমার দেখা বাংলা একাডেমি কেমন যেনো নেতিবাচক ভাবে পাল্টাচ্ছে। শাহবাগ আন্দোলনের পর যখন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বদল ঘটছে সেই সাথে একাডেমির বিবর্তনও লক্ষণীয়। তা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা বিবেচ্যবিষয়।আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক পরিবর্তনই ঘটেছে বেশি। 

যাইহোক, বইমেলা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই, গতবারের বইমেলাটা ছিলো জেলখানার মতোন। আর ভিতরে যারা ঘুরাঘুরি করছে তাদেরকেও কয়েদির মতো লেগেছে। মানুষ বইমেলাতে বইকেনা, আড্ডা ঘুরাঘুরির চেয়ে হয়রানি ও বিরক্ত হয়েছে। হ্যাঁ, আমি বলছি না যে নিরাপত্তার কোন প্রয়োজন নেই। অবশ্যই প্রয়োজন আছে তবে তা যেন অবরুদ্ধ, দমবন্ধ হয়ে মানুষের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক লেখকরা যেনো অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বইমেলায় বিচরণ করতে পারে সবার আগে তা নিশ্চিত করা। যত্রতত্র অব্যবস্থাপনা, বসার স্থান সংকট, লিটলম্যাগ চত্ত্বরে বাণিজ্যিক প্রকাশনার বইয়ের দৌরাত্ম, অস্বাভাবিক ভাবে মিডিয়া স্টল, রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের স্টল বরাদ্দ দেওয়ায় বইমেলার শ্রী ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়েছে। এছাড়াও গতবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমির নতুন বিল্ডিং এর সাথে যে অস্থায়ী খাবারের হোটেলটি ছিলো তা মূলত বইক্রেতাদের পকেট কেটেছে। এটা মনে রাখতে হবে যে, বইমেলার সিংহভাগ ক্রেতা কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা তারা যদি বই কিনতে গিয়ে ফতুর হয়ে যায় এর চেয়ে দু:খজনক আর কি হতে পারে ! গতবারের এই হোটেল কেন্দ্রিক একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে কবি আমীর খসরু স্বপন ভাইয়ের সাথে পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। অস্বাভাবিক মূল্যে এই খাবারের হোটেলটিতে দামধর না জেনে খেতে গিয়ে অনেকেই আশানুরুপ বই না কিনে এক পর্যায়ে নি:স্ব হয়েই বাসায় ফিরেছে। গতবারের বইমেলাতে কবি সরদার মেরাজ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, বই কিনতে এসে বেচারা খুবই স্বল্প মূল্যের খুব সম্ভবত কয়েকটা সাহিত্যের পত্রিকা কিনে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। বেকার, আয় রোজগারহীন লেখকরাতো ঐ হোটেলের যাওয়ার সাহসই পান নি। যদি হোটেলটিতে বাজার মূল্যে খাবার বেচাকেনা হতো তাহলে মেলায় আসা আগত পাঠক লেখকদের চরম অর্থসংকটে পরতে হতো না।

গতবারের বইমেলায় বদ্বীপ নামে একটি প্রকাশনীকে ধর্মীয় বিতর্কমূলক বই প্রকাশের অযুহাতে বন্ধ করে দেওয়াটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো ! যে বইটি নিয়ে আপত্তি সে বইটি নিয়ে লেখকের সাথে কথা বলে মেলা কমিটি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারতো কিন্তু তা না করে বইটি প্রকাশ করার অপরাধে বদ্বীপ প্রকাশনীকেই ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করল ! তা অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানজনক। আমি দৃঢ়ভাবেই, বিশ্বাস করি যে, বাংলা একাডেমিতে যারা চাকুরি করেন তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী ও সৃজনশীল মনের মানুষ। কোন না কোন ভাবে হয়তো উনারা অদৃশ্য চাপ থেকে এই সব নিন্দিত ও ঘৃণিত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। যা প্রকৃতপক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনেকরি। 

গত ২৬ তারিখে বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনীর মধ্যে একটি শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করলো তা কি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিলো! কি এমন গুরুতর অপরাধ যে শ্রাবণ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করা হলো ! যদি বাংলা একাডেমির দৃষ্টিতে শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী রবিন আহসান ভুল করে থাকে তাহলে তা ব্যক্তি রবিন আহসানের সাথে আইনি লড়াইয়ে যেতে পারতেন। রবিনকে ডেকে এনে উনার সাথে কথা বলতে পারতেন। তা না করে আবারো প্রকাশনা নিষিদ্ধ ?  তা কোন ভাবেই মানা যায় না। তা কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। পত্রিকাসূত্রে যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয় না রবিন আহসান মহা কোন ভুল করেছেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি তো কোন দোষ করেন নি। রবিন আহসান একটি অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে যদি কিছু বলেও থাকে তখন তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া জানায় নি কেনো বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ! বইমেলার এক মাস বাকি থাকতে শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী রবিন আহসান তা জানতে পারলেন ! তা সত্যিই বড্ড অন্যায় ও অবিচার। এই যে নিষিদ্ধের খবর শুনে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে বই বের করা বা বই প্রকাশের প্রক্রিয়াধীন লেখকরা কি স্বস্তিতে আছেন ? নিশ্চয় না । তারা ভীষণ অনিশ্চয়তা, দুঃশ্চিন্তাও উৎকন্ঠার মধ্যে আছেন। আমার মনেহয়, এই প্রকাশনীটি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যেও পড়েছে । এই ক্ষতি কি পূরণ করা সম্ভব ? সেপ্টেম্বরে যদি এই সিদ্ধান্ত বাংলা একাডেমি নিয়ে থাকে তো তখনই রবিন আহসানকে জানানো অবশ্যই উচিত ছিলো।

রবিন আহসান তার যে কোন মত প্রকাশের অধিকার রাখে। এটা তার স্বাধীনতা ! । মত প্রকাশের অধিকার সবার। স্বাধীন দেশে যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারে কেউ তাহলে স্বাধীনতার মানে কি!  আমার কথা বলাতেই যদি নিষিদ্ধের পাথর চেপে রাখা হয় তাহলে আপাতদৃষ্টিতে বেঁচে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আমি তো মৃতই । অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা অ্ন্যায়ের প্রতিবাদ করতে  বাধা দেওয়া হয় তাহলে অন্যায়ের ডাইনোসর আমার প্রিয় জন্মভূমিকে তো একদিন গ্রাস করে নিবে। যাইহোক, শ্রাবণ প্রকাশনীর উপর এই অন্যায় সিদ্ধান্ত থেকে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সরে আসবে বলে আমি আশা করি। আসন্ন প্রাণের একুশে বইমেলা যেনো সকল মানুষের, বাঙালি সাহিত্যপিপাসু পাঠক-লেখকদের অত্যন্ত  প্রাণবন্তও মুখরিত বইমেলা যেনো হয় সেই ইচ্ছা পোষণ করি ।   

বিষাদ আব্দুল্লাহ
২৮/১২/১৬, ঢাকা।
ছবি: অন্তর্জাল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন