পয়লা মে শ্রমিক দিবসে শাহবাগে গেলাম সন্ধ্যার দিকে। পাঠক সমাবেশে গিয়ে বরাবরের মতো আড্ডা আর বইয়ের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকার অভ্যাসবশত স্বভাবদোষে বই নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে করতে লিটলম্যাগ কর্ণারের দিকে আসি। বিভিন্ন লিটলম্যাগ ঘাটাঘাটি শুরু করতেই চোখে পড়লো ‘চর্চা’ নামক এক ছোট কাগজের। লিটলম্যাগটির সম্পাদকের নাম বোধ হয় অমর্ত্য আতিক। চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ, বাংলাবাজার থেকে পত্রিকাটি বের হয়। আট দশটা গতানুগতিক লিটলম্যাগের মতই একই রকম, গৎ বাধা মেজাজের। বিপুল পরিমাণে কবিতা (?) দিয়ে ঠাসা আর দুয়েকটা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, অনুবাদ দিয়ে প্রচ্ছদবদ্ধ হয়েছে।
সবচে বিস্ময়কর এবং ক্রোধ হলো , ছোট কাগজটির কবিক্রম দেখে, সম্পাদক সাহেব, প্রথমে সমসাময়িক কবিদের (পুরুষ কবি ?) নিয়ে যারা ওঠতি তরুণ কবি সবেমাত্র দুয়েক একটা কবিতাগ্রন্থ বের হয়েছে কিংবা সদ্য পরিচিতি লাভ করেছে পাঠক মহলে এমন কবিদের (পুরুষ কবি ?) সমন্বয়কে মাথায় রেখে পত্রিকাটির কবিতার জন্য প্রথম অংশ সাজানো হয়েছে। তারপর যারা প্রথম অংশের কবিদের চেয়ে কম পরিচিত কিংবা সবেমাত্র লিখছে অথবা কারও কারও হয়তো শুরুটাও হয়েছে এই পত্রিকার মাধ্যমে এমন কবিদের (পুরুষ কবি ?) নিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতার জন্য পত্রিকাটির দ্বিতীয় অংশ। তারপর লিটলম্যাগটির একেবারে শেষাংশে বরাদ্দ হলো কবিতার জন্য পত্রিকাটির তৃতীয় অংশ। এই অংশে সাজানো হয়েছে পরিচিত-অপরিচিত কবিদের (নারী কবি ?) নিয়ে।
কি ভয়াবহ ! কি সাংঘাতিক অবস্থা শিল্পের ! কবির তো কোন লিঙ্গ হয় না। কবি’র তো কোন শ্রেণি নেই। তবে কেনো শ্রেণিকরণ ! এই পত্রিকাটি কবিদের বানিয়ে দিলো পুরুষ কবি ? নারী কবি ? কি উদ্দ্যেশ্য এ সম্পাদকের ! এটা কি ছোট কাগজের নতুন ধারার উন্মোচন ! নাকি স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেশতের মতন কিছু একটা বোঝাতে মরিয়া এই সম্পাদক এবং পত্রিকাটির সম্পাদনা পরিষদ !
এসব আগাছা-পরগাছা সম্পাদক নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত কি হবে তা মাথাটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক মারপ্যাঁচে না ফেলে সহজে বলে দেয়া যায়, স্রেফ তা সাহিত্যের বর্জ্য। এই দেশে উন্মাদ চোখবাধা ঘোড়ার মতন মিডিয়াবাজ, প্রচারমুখী লেখকদের লেখা ছাপানোর আনন্দের মনোবৃত্তির কারণেই সাহিত্যের ছোট কাগজগুলির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে যেতে পারে !
দৈনিক পত্রিকার গৎ বাধা, স্বজনপ্রীতির বলয় দ্বারা তৈরি সাহিত্য পাতাগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন কেউ কেউ সাহিত্যে ছোট কাগজ করে সাহিত্যের মৌলিকত্বকে ধরে রেখে, অক্ষুন্ন রেখে সাহিত্যে নব বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাখছে, নতুন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দ্যাখছে, নতুন মানবতামুখী, মানুষমুখী, শ্রেণি বৈষম্যহীন নতুন পৃথিবী নির্মাণে ব্যতিব্যস্ত ঠিক তখনি দেখা যাচ্ছে, ছোট কাগজে মুনাফাখোর সম্পাদকদের মাধ্যমে প্রচারমুখী, বুর্জোয়া লেখকদের নতুন বসবাস। ধান্দাবাজ, বুর্জোয়া লেখকরা এবং পথভ্রষ্ট, আদর্শ্যচুত্য অথবা ভুলপথে হাঁটা তরুণ লেখকরা এসব ছোট কাগজের যোগানদার ও খরিদ্দার হয়। তাহলে নির্ধিদ্বায় স্পষ্টত বলা যায়, শিল্পের অবয়ব ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অথবা খুব শীঘ্রই হতে চলেছে। মুনাফাখোর সম্পাদকদের কবলে পড়ে উদীয়মান তরুণ লেখকরাও তাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করছে হচ্ছে পথভ্রষ্ট । মুনাফাখোর সম্পাদকদের প্রথম টার্গেটই হলো ওঠতি তরুণ লেখকরা ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব লেখক-সম্পাদকদের দৌরাত্ম বেশি। সর্বক্ষণই দেখা যায় কোন না কোন ভাবে তাদেরই মন-মেজাজে গড়া, তৈল মর্দন করা লেখকদের লেখায়(?) বাহবা দিতে, প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিতে। তাতে করে স্পষ্টত দেখা যায়, তাদের ফাঁপা মনের জগত। এসব লেখকদের মনো গঠন এবং মগজের জড়তা যেমন কাটে না অন্যদিকে পৃথিবীর গতানুগতিক গতিপথের বীপরীতে নব চিন্তাবীজ তাদের মন-মগজেও রোপন হয় না। তাদের নব চিন্তা করার সাহস তৈরি হয় না।
এই ছোট কাগজটি দেখে মনে হয়েছে, সাহিত্যের ভিতরে মারাত্মক, ভয়াবহ শ্রেণি বৈষম্য এসে গেছে। সে দিকে মৌলিক শিল্প-সাহিত্য চর্চাকারীদের সজাগ দৃষ্টি অতীব জরুরি। তা না হলে, ছোট কাগজের মেজাজ নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনেহয়, প্রকাশনী থেকে সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রকাশ না করাই উত্তম। এতে স্বজনপ্রীতির কারণে ব্যবসায় মুনাফার লোভ সংবরণ না করার ফলে এসব কাগজগুলোর ভিতর থেকে নবচেতনার দ্বার উন্মোচিত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া, ছোট কাগজগুলোতে লাভ নয় লোকসানটাই বেশি। ফলে, নিশ্চয় একজন প্রকাশক সেই ঝুঁকিটা নিবে না। রিম-রিম কাগজ নষ্ট করতে চাইবে না। তবে কেনো তারা প্রকাশ করে ? প্রকাশনা থেকে যে সব কাগজ বের হয় আমার ধারণা, প্রকাশনী থেকে ছোটকাগজ প্রকাশ করার পিছনে একটা অসৎ উদ্দ্যেশ্য আছে । তরুণ লেখকদের তাদের ফাঁদে ফেলে অধিক মুনাফার লাভ করা। সাহিত্যের চেয়ে তাদের লাভটাই মুখ্য। তবে ব্যতিক্রমও থাকতে পারে।
যাইহোক, সাহিত্যে স্পষ্টবাদী, সত্যনিষ্ঠ, তুখোড় মৌলিক সাহিত্য সম্পাদকের বড়ই অভাব, এর পিছনে সবচে বড় কারণ প্রকৃত সাহিত্য চর্চার অভাব। নতুন চিন্তার বীজ বপন করার অক্ষমতা। দল-মত-র্নিবিশেষে সবকিছুর উর্ধ্বে ওঠে সাহিত্যকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার অভাব। একজন লিটলম্যাগ কর্মী হিসেবে মনেহয়, লিটলম্যাগ হলো, নবচিন্তার বীজ বপন করার ভূমি, সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন একটা অধ্যায় নির্মাণের রোড। লিটলম্যাগ থেকেই সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে নতুন এক সাহিত্য জগত নিমার্ণ করা সম্ভব আর সেজন্য দরকার দক্ষ, নির্মোহ, নির্লোভী, পড়ুয়া, প্রতিভাবান ও মেধাবী সাহিত্য সম্পাদক।
বিভাগ: সাহিত্য আলোচনা।
প্রকাশ: ০২.০৫.২০১৭, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন