Ads

শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

শিল্পস্রষ্টাদের চরিত্র-চরিত্রহীনতা ও প্রতিষ্ঠান ! - বিষাদ আব্দুল্লাহ



একজন শিল্পস্রষ্টা প্রতিষ্ঠান বিরোধী। বিশ্বাস করুন আর নাই বা করুন। একজন শিল্পী তার সৃষ্টি নিয়েই মহাকালে ভাস্বর। শিল্প ও শিল্পী সবর্শেষ টিকে থাকে। কোন প্রতিষ্ঠান তাকে টিকে রাখে না। যার শিল্প মহাকালে ঠাঁই হয়ে যায় সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকে যায়। তাহলে প্রতিষ্ঠানের কি কাজ ! প্রতিষ্ঠানে একজন শিল্পস্রষ্টার ভূমিকা কি ! এভাবে হরেক রকম প্রশ্ন আমরা দাঁড় করিয়ে দিতে পারি কিন্তু ভেবে দেখলে দেখা যায় শেষাব্দি একজন নিখাঁদ শিল্পী এবং তার শিল্পকর্মই পাঠক-লেখকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সবসময়। শিল্প-সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে তা সবকালেই একটা বিতর্কে-তর্কে আর ধোঁয়াশার ভিতরে। কোন জীবিত লেখক যখন চায় যে তার চিন্তা-ভাবনার জগতের আলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্রে, প্রয়াত লেখকদের আলোর মশাল প্রতিটি মানুষের চিন্তার দ্বার ভেঙ্গে দিক। ঠিক তখনি প্রতিষ্ঠান সামনে এসে যায়।

একজন লেখকের শিল্পকর্ম মানুষের ভিতরে ছড়িয়ে দিতে একটা মাধ্যম প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কাজ করে যেমন হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যা বিশ্বব্যাপী একটি উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠান, কোন বই প্রকাশনী, শিল্প-সাহিত্য কেন্দ্রিক চর্চাকেন্দ্র যেমনঃ কলকাতার বাংলা আকাদেমি, বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সকল প্রতিষ্ঠান কবি-লেখক-পাঠক, শিল্পনুরাগী, শিল্পচর্চাকারীদের নিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য আলোকিত মানুষদের আলো যেনো সমগ্র মানবসত্তার দ্বার খুলে মানবকূল আলোর ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেয়। সমগ্র পৃথিবীর নাভিমূল যেনো দ্রুত নির্ণয় করে নিতে পারে মানবসমাজ। পৃথিবীর রুপ-রহস্যের জাল ছিঁড়ে তার রুপ-রস- সৌন্দর্য আস্বাদন করতে যেন পারে। একটা সত্যসুন্দর সমাজের ভিতর দিয়ে পৃথিবী হয়ে ওঠুক সব মানুষের যেনো পৃথিবীটা একটা শোষণ-বঞ্চনাহীন মানুষের  দুনিয়া।

প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা যদি তাই হয় তাহলে বিতর্ক কেন ! বিতর্কের শুরু তখনি যখন প্রতিষ্ঠানের ভিতরকার কর্তাব্যক্তিদের ব্যর্থতা, অসততা, লোভ, অযোগ্যতা, মুনাফা, ব্যক্তি হিংসা ! তখনি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় অন্ধ, বাকহীন সেই সাথে বধির। যার ফলে, মানুষের ভিতরে সত্যসুন্দরের আলো আজোব্দি পৌঁছাতে পারে নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর অদূরদর্শিতা, দলান্ধ, কুরুচিপূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক আচরণের ফলে এসব প্রতিষ্ঠান বিতর্কের মুখে থুবড়ে পরেছে। যার ফলে কোন কোন প্রতিষ্ঠান প্রকৃত শিল্পস্রষ্টাকে খোঁজে বের করতে চরমভাবে ব্যর্থ। তাদের উদ্দেশ্য বিভাজন-দ্বন্দ্ব, পছন্দের লেখকদের নিয়ে হৈ-চৈ করা যা মূলত ফাঁপা কিংবা শিল্পচর্চার জন্য মারাত্ম হুমকি ! এধরণের প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম আরেকটি কাজ গতানুগতিক অনুষ্ঠান কিংবা পুরস্কার (ব্যবসা) প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের দূরদর্শিতার প্রমাণ দেখানো ! আদতে কি তাই ! এসব কিছুর প্রমাণ মিলে তাদেরই কর্মক্ষেত্রে যেমন ধরা যাক, তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে বই করা, তাদের নিয়ে ঢাউস ঢাউস শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক পত্রিকা প্রকাশ করা। সাহিত্যপাড়ায় অর্থহীন ঝড় তোলা। আবার এসব প্রতিষ্ঠান ধার না ধারা আপোষহীন কবি-লেখকদের ও নিয়েছে অনায়সে ! যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো সবকালেই একটা তর্ক-বিতর্কের ভিতর দাঁড়িয়ে। তাদের ভালো দিক, কারও রুটি-রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে, কেউ কেউ অবশ্য ভালো কিছু সৃষ্টিকর্মও করেছে,  প্রকৃত শিল্পর্চচাকারীদের  কাউকে  কাউকে অবশ্য খোঁজেও বের করেছে।

আরেকটা ভয়ংকর দিক হলো, শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানকে যখন বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভাবিত করে তখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয়! বুর্জোয়া গণমাধ্যমদের নগ্ন হস্তক্ষেপ, অসৎ আমলাদের নোংরা হস্তক্ষেপের কারণেও শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো শেষাব্দি তাদের প্রধান উদ্দেশ্যে থেকে সরে যায় অথবা সরে আসে কিংবা বাধ্য হয় সরে আসতে। বুর্জোয়া মাধ্যমগুলোর ফলে বাংলা সাহিত্যেও ভয়াবহ রুগ্ন অবস্থাও বিরাজ করছে। বিশেষ করে হালের তরুণরা নিজেদের সত্তার ভিতর থেকে উধাও হয়ে বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে খ্যাতির চূড়োয় ওঠার জন্য বিকিয়ে দিচ্ছে নিজেদের যার আরেকটা চূড়ান্ত রুপ পুরস্কার(!), তথাকথিত সাহিত্যানুষ্ঠান। শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্রের ক্রমান্বয়ে অধঃপতনের ফলে একদিন শিল্প-সাহিত্যচর্চাকারীদের অন্যকোন নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করতে হবে। তবে একথাও স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই, লেখকদের সাথে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর  সম্পর্ক থাকার ফলে লেখকরা পাঠকদের কাছে দ্রুত পৌঁছায়।

একজন প্রকৃত শিল্পস্রষ্টার ভূমিকা কি এসব প্রতিষ্ঠানে !  যদি এক কথায় বলি, শিল্পস্রষ্টাদের কোন ভূমিকাই নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। কারণ একজন শিল্পস্রষ্টা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান তাহলে কি তার অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের দরকার আছে! রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনান্দ-ইলিয়ট-হোমার-র‌্যাঁবো-শেক্সপিয়র-প্লেটো এসব শিল্পস্রষ্টারা একেকটা প্রতিষ্ঠান । যাদের ঘিরে হাজারো প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। প্রকৃত শিল্পস্রষ্টারা এসব প্রতিষ্ঠানে শেষাব্দি টিকে থাকতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে, কেউ কেউ টিকে যায়। তবে তাকেও একটা নষ্ট সমাজ, নষ্ট পদ্ধতির সাথে সমন্বয় করে টিকে থাকতে হয়। আর যাদের প্রাতষ্ঠানিক লোভের মোহ থাকে তারা তো শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বর্বস্ব বিক্রি করে দেন। তখন শিল্পসত্তার বদলে শিল্পবেত্তা হয়ে ওঠেন  কেউ কেউ। একজন শিল্পস্রষ্টা শিল্পবেত্তা হবেন ঠিকই কিন্তু তিনি হবেন সর্বত্রে আপোষহীন। কারণ তিনি নিজের বিরুদ্ধেও লড়তে জানেন। 

শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো চরিত্রহীন হয়ে ওঠার পিছনে আরেকটা উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নষ্ট হস্তক্ষেপ। যার ফলে রাজনীতি কর্মীরা তাদের পছন্দমত তাদেরই পোষা তথাকথিত প্রগতিবাদী মানুষদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন যেনে তারা আখের গোছাতে পারে। যার ফলে এই দেশে দুইটা লেখক শ্রেণি আছে বলে অনেককে বলতে দ্যাখি( মূলত লেখকদের কোন শ্রেণি নেই, সমাজ নেই) তা হলোঃ সরকারি লেখক শ্রেণি আর বেসরকারি লেখক শ্রেণি। দুই শ্রেণির মধ্যেও অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। সরকারি লেখক শ্রেণির কাতারে যারা আছে তারা যে রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করুক তা স্বাধিনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা স্বাধীনতার পক্ষের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হোক তারা সরকারেরই গুণগান গাইতে থাকে। পোষা পাখিকে কথা শিখিয়ে দেওয়ার মত তাদের অবস্থা। দেশের ভিতরকার যেকোন ইতিবাচক-নেতিবাচক কর্মকান্ডে তাদের অংশগ্রহণ থাকে সেই সাথে নিজেদের শক্তি-সাহসও প্রদর্শন করে। পোষা বিড়ালের মত তাদের অবস্থা, তাদের মাঝে মাঝে রাজপথেও দেখা যায়, সেটা মূলত লোক দেখানো! দন্তহীন বাঘের মত ভূমিকা। যদি মানুষের পক্ষে তাদের শুক্ত কোন অবস্থান থাকতো তবে সমাজের ক্রমান্বয়ে উন্নতি পরিলক্ষিত হতো। মানুষের মধ্যে আরেকটা শ্রেণি আছে সুধী শ্রেণি। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্ত আর সুধীবিত্ত। সরকারি লেখকরা সুধীবিত্ত শ্রেণির । যত্রতত্র যে কোন সাহিত্যানুষ্ঠানে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে তা না হলে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতির শঙ্কা থেকে যায় ।কেউ কেউ অবশ্য শঙ্কা আছে জেনেও মান সম্মত সাহিত্যানুষ্ঠান করে যাচ্ছে। যাইহোক, বেসরকারি লেখকরা দন্তময় বাঘ হলেও মূলত কোণঠাসাই থেকে যায় সবসময়। রাষ্ট্রছায়া মুক্ত, সমাজছায়া মুক্ত  ।

প্রগতিশীল লেখক শ্রেণি শুধু রাষ্ট্রের নয় পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সব লেখক নয়। যারা প্রকৃতপক্ষে মানুষের কাতারে শামিল থাকে সর্বত্রে, কেবল তারা। এ সব লেখকরা রাষ্ট্রকে শিকল মুক্ত করে, পৃথিবীকে করে তোলে বাগিচা। একবিংশ শতাব্দিতে এসে ক্রমান্বয়ে দুঃখজনক হারে লেখকদের আপোষহীন চরিত্র, মু্ক্তচিন্তা, সুচিন্তার বুনন, দর্শনগত জায়গায় গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে, শুধু নিজ রাষ্ট্রেই নয় পৃথিবীব্যাপী হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি আর অস্ত্রশক্তি  ঘড়ির কাটার চেয়ে দ্রুত পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে যা  খুবই উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ ! 

প্রকাশকালঃ ০৯.০৬.২০১৬, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন