Ads

মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০

করোনা দিনের লিপি



১.
সবচে বড় ভুলটা আমরা করে ফেলেছি। প্রথম থেকে সরকারের কড়া নজরদারি দরকার ছিল। খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। মানুষের মুখের দিকে তাকানো যায় না। যেন সন্দেহ, ভয়, আতঙ্কে সবাই অস্থির। আমাদের প্রশাসন তৃণমূল থেকে সবাইকে সচেতন করতে ব্যর্থ। মন্ত্রীদের বেফাঁস কথাবার্তা মানুষকে আরও বেশি অস্থির করে তুলেছে যা কোনমতেই কাম্য ছিল না। করোনা ভাইরাস দেশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রবাসীদের দেশে ফেরাটা কঠোরভাবে বন্ধ করা উচিত ছিল। যা করতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ দয়া করে কোন পণ্যের দাম বাড়াবেন না। প্রবাসী ভাইদের প্রতি অনুরোধ যারা দেশে এসেছেন এবং আপনারা নিজেদের শঙ্কামুক্ত ভাবছেন, তবুও বলবো, প্লিজ আপনারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকুন। আপনারা বাঁচুন, আমাদের বাঁচান।

২২ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।

২.
ইতোমধ্যে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এইসব কথা বলেছে। তবুও বলছি, দিনমজুররা এই করোনা ভাইরাস কারণে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথবা খুবই স্বল্প আয়ের মানুষজন। এককথায় যদি বলি, যাদের উপার্জন দিনে দিনে ফুরিয়ে যায় তারা সবচে বেশি বিপদের সম্মুখীন। সকলের সাথে আমিও একমত। এইসব নিরীহ মানুষজন খাদ্যের অভাবেই শুধু ভোগবেনা সেইসাথে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকেও মুক্ত নয়।
সুতরাং সামর্থ্যবান সকলেই যার যার জায়গা থেকে এইসব অসহায় মা-বাবা-ভাই-বোনদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। এখন থেকে এই মুহূর্ত থেকে এগিয়ে আসুন। সমাজের বিত্তবানদের কাছে অনুরোধ, আপনারা দয়া করে এইসব অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। ব্যবসায়ীদের সকলেই চাইলে নিত্যপণ্য জাতীয় খাবারদাবার বিনামূল্যে এইসব মানুষদের সাহায্য করতে পারেন, দরকার শুধু সদিচ্ছা, বিপদে মানবিক সহায়তায় খুবই জরুরি।
এবং সবচে বড়কথা, করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি রাষ্ট্রকেই সবার আগে অসহায় মানুষদের দায়িত্ব নিতে হবে খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে। বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যারা ফুটপাতে, বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে তারা যেন ক্ষুধা ও করোনা ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পায় আমাদের সকলের এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
কারণ শুধু আপনি নয়, আমি নয়, বাঁচলে আমরা সকলেই একসাথে বাঁচবো। এই ভাইরাসের কবল থেকে কেউই একা একা বাঁচতে পারবেন না। দরকার সকলের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা। মুঠোফোনের মাধ্যেম আপনার চারপাশের মানুষজন কেমন আছে, তার খোঁজখবর রাখুন। ভালো থাকুন। সকলে নিরাপদে থাকুন।

২৩ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।

৩.
ভাবতেই ভয়ে শিয়রে উঠছি, যারা শহর থেকে গ্রামে গেল। তারা করোনা বহন করে নিয়ে গেলো না তো! তাহলে কিন্তু আর কোনকিছুই কাজে আসবে না। ভালো থাকুন, থাকুন নিরাপদে।

২৪ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।

৪.
কানে হেডফোন লাগিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখতেছিলাম, 'একাত্তর' নামে। দেখতে দেখতে মধ্যেরাত, প্রায় ৩টার কাছাকাছি বাজলো। সিরিজটা দেখার ফাঁকে ফাঁকে আবছা আবছা মসজিদে মুয়াজ্জিনের তেলাওয়াত শুনতে পেলাম। তখন বোধহয় আনুমানিক সাড়ে ১২ টা বাজে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অল্প কিছুক্ষণ ধরে শুনলাম। কয়েকদিন আগেও রাত ৯/১০ দিকে মসজিদে জিকির করতে শুনেছিলাম। কিন্তু মধ্যেরাত অব্দি শুনি নাই। যাইহোক, আবার মনোযোগ দিলাম 'একাত্তর' ওয়েব সিরিজে।
যখন দেখা শেষ তখন মাহবুব (সহকর্মী) হোয়াটস এপে ১.১৭ (আজ রাত) মেসেজ দিল যে ১২ টার (আজ রাত) দিকে আযান শুনেছি কিনা। রিপ্লাই দিয়ে রেখেছি যে, তেলাওয়াত শুনেছি। পরক্ষণে ভাবলাম এটা কি হ্যালুসিলেশন
অফিসের কলিগদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য আমার তৃতীয় ফেসবুক আইডি খোলা আছে। সেই আইডিতে ঢুকে দেখি অনেকের স্ট্যাটাসে ঘুরতেছে- ঠাকুরগাঁওয়ে নাকি একটা শিশু জন্মাবার পরেই কথা বলতেছে, শিশুটি নাকি বলেছে, মসজিদে আযান দিতে এবং কালোজিরা, মধু ইত্যাদি খাইতে। এ ধরনের স্ট্যাটাস চোখে পরলো সাথে লাল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর গুজব শব্দটি লিখে মাইকের আকৃতি আঁকা একটা ছবি।
বুঝলাম, কারা যেন গুজব ছড়িয়েছে। এজন্য কলিগরা সচেতন স্বরুপ ওই পোস্টসহ গুজব শব্দটি লেখা সংবলিত মাইক আকৃতির ছবিটি পোস্ট করলো। ঘোর কাটলো। বুঝলাম, এ কারণেই মসজিদে মধ্যরাতে তেলাওয়াত শুনলাম। মসজিদের মোয়াজ্জিনও এই গুজবের পাল্লায় পড়ে তেলাওয়াত শুরু করে দিলো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কারা এসব করছে! কেন করছে! কি লাভ তাতে! মানুষকে ভয় দেখিয়ে কারা এতো সুখ পায়! এমনিতেই মানুষ খুব বিপদে আছে, ভীষণ ভয়ে আছে। তার উপরে অবান্তর, বানোয়াটি, আজগুবি কথাবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার কি কোন মানে হয়! এসব পিশাচদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। এরা মানুষ নয় জাস্ট অমানুষ। এসব হিংস্র দানবরা জানে না, একবিংশ শতাব্দীতে সব মানুষকে বোকা বানানো এত সহজ নয়।

নোয়াখালী
২৭.০৩.২০২০ ( ২৬ মার্চ দিবাগত রাত)

৫.

যে দেশে ছেলে ধরার গুজবে রাস্তায় মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলে, সেই দেশে সবই সম্ভব! হুজুগে বাঙালিরা একটা জিনিস খুব সুনিপুণভাবে ছড়াতে পারে তা হলো গুজব:
১. সাঈদীকে চাঁদে দেখা।
২. ঠাকুরগাঁওয়ে নবজাতক জন্মাবার সাথে সাথে কথা বলা। আযান দেওয়া।
৩. চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাসে ১৮ জনের মৃত্যু। চিকিৎসকের অডিও ভাইরাল।
৪. পদ্মা সেতু করতে মাথা প্রয়োজন।
৫. এক টাকার লাল পয়সা সংগ্রহ।
৬. বিলুপ্ত প্রায় তক্ষক সংগ্রহ।
৭. বাঁশ গাছের পানি পানি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড।
এভাবে লিখতে গেলে গুজবের তালিকাটা আরও বড় হতেই থাকবে । বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমের দুনিয়ায় নিজের বিবেককে সজাগ রাখুন। যেকোন ভাইরাল হওয়া খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাছাই-বাছাই করুন। দেশের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার দিকে নজর রাখুন। কোন ভুয়া খবর-তথ্য শেয়ার করবেন না। এইসময় ধৈর্য্য ধরে নিজের চোখ কান খোলা রাখুন। বিশ্বাস রাখুন নিজের ওপর। কারো শোনা কথা বিশ্বাস করার আগে ভালো করে যাছাই করুন। ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। আতঙ্ক ছড়াবেন না, আতঙ্কিত হবেন না।

২৭ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।

৬.
জুমা'আর নামাজে গিয়ে না জানি কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়! বলি ভালো থাকুন সকলে, নিরাপদে থাকুন।

২৭ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।
৭.
হোম কোয়ারেন্টাইনে অষ্টম দিন। ধৈর্য্যসীমা আর টিকতেছে না। এভাবে ঘরবন্দি জীবন কোনদিন পার করিনি। বাড়িও যেতে পারছি না। কর্মস্থলে পড়ে রয়েছি। বোউ দিনে হাজারবার বলে বাড়ি আসতে! আর মন টিকে না গো আর টিকে না।

৩১ মার্চ ২০২০, নোয়াখালী।

৮.
দুয়ারে দুয়ারে কড়া নাড়ে, কে যেন কড়া নাড়ে। মানুষের মন ভালো নেই। নেই পৃথিবীরও। কে যেন কড়া নাড়ে, কোথায় যেন কান্নার রোল পড়ে গেলো। হসপিটালে- হসপিটালে দৌড়াতে দৌড়াতে অবশেষে কে যেন কফিনে মোড়িয়ে চলে গেলো। কেউ কিছুই করলো না, অথচ তার বাঁচার সবটুকু অধিকার ছিল। বাহিরে জমিনে ছড়িয়ে পরেছে এখন চাঁদের আলো। দেখো, কেউই দেখছে না, কেউই দেখে না। যেন ঘরই সর্বসত্য বলে মেনে নিয়েছে। এবং ঘরই সত্য। ভেবে দেখলাম, মানুষ চাঁদের আলো দেখে না, ফলে চাঁদ অর্থহীন, যেন কাগজে মোড়ানো ঢোঙা। মিছিলে মিছিলে মৃত্যু হাঁটে, আমাদের মন শক্ত করা দরকার। জানি এই পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর একদিন আমি-তুমি ভাগাভাগি করে নিবো। প্রিয়তমা, মৃত্যু সত্য হলেও মনেরেখো, বেঁচে থাকা সুন্দর।

০৯.০৪.২০২০, বাড়িতে।

৯.

বাড়িতে বৈশাখ এভাবেই আসে। প্রতিবছর এরকমভাবে বছরের প্রথম দিনটি আমাদের ঘরে উৎযাপিত হয়। কোন পান্তাভাত আর ইলিশ নয়। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, এভাবেই আমাদের ঘরে পালিত হয়। হয়তো, আরও কিছু আইটেম থাকে। এবারের পয়লা বৈশাখ করোনার ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তবুও মনের বৈশাখে রঙ তো লাগবেই। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মানুষজন। ভালো থাকুক, নিরাপদে থাকুক প্রিয়জন। সবাইকে শুভ নববর্ষ ১৪২৭ এর শুভেচ্ছা।

পয়লা বৈশাখ ১৪২৭, বাড়িতে। ১৪.০৪.২০২০।
বাড়িতে করোনাদিনে বৈশাখ উৎযাপন




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন